আইসিটি অঙ্গনে বিশাল প্রতিশ্রুতি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে এমন কিছু প্রযুক্তি। যা দীর্ঘদিন পরও প্রত্যাশিত ফল দিতে পারেনি। যেমন- ‘কণ্ঠস্বর চেনা’ বা ‘Speech Recognition’-এর কথা। এখনো এর তেমন কার্যকর প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। তেমনিভাবে ৬৪ বিট কমপিউটিংয়ের কথা বলা যায়। কমপিউটিংয়ের মূল স্রোতধারার সাথে এ যেনো খাপ খাওয়াতে পারছে না। সবখানে যেনো ৩২ বিট কমপিউটিংয়ের রাজত্ব। ৬৪ বিট কমপিউটিংয়ের জন্য তিনটি উপাদান অপরিহার্য- ০১. ৬৪ বিট প্রসেসর, ০২. ৬৪ বিট অপারেটিং সিস্টেম (উইন্ডোজ) এবং ০৩. ৬৪ বিট ড্রাইভার এবং অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার।
ইন্টেল ও এএমডি অনেক আগেই ৬৪ বিট প্রসেসর (X86) বাজারে ছেড়েছে; সুতরাং এটি কোনো সমস্যা নয়। দ্বিতীয়ত, মাইক্রোসফট ৭ বছর আগে ৬৪ বিট এক্সপি বাজারে ছেড়েছে; সুতরাং এ বিষয়টিও নিষ্পত্তি হয়েছে বলা যায়। সুতরাং দেখা যায়, ৬৪ বিট কমপিউটিংয়ের বড় বাধা হচ্ছে ৬৪ বিট ড্রাইভার এবং ৬৪ বিট অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যারের অপ্রতুলতা। ৩২ বিট ড্রাইভারের অসাযুজ্যতা (incompatibility) এ বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছে। তবে এরই মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান আশার আলো জ্বালিয়েছে। যেমন- অটোডেস্ক এবং অ্যাডোবি এদের বহুল জনপ্রিয় অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যারের ৬৪ বিট ভার্সন ইতোমধ্যে বাজারে ছেড়েছে। ডেল এবং লেনোভো তাদের ল্যাপটপে ৩২ বিটের পাশাপাশি ৬৪ বিট অপারেটিং সিস্টেম দিচ্ছে। ইতোমধ্যে মাইক্রোসফট ঘোষণা দিয়েছে উইন্ডোজ সার্ভার ২০০৮ হবে তাদের শেষ অপারেটিং সিস্টেম- যাতে ৩২ বিট ও ৬৪ বিট ভার্সন থাকছে। এর পরের ভার্সনে ৩২ বিট আর থাকবে না।
৬৪ বিট কমপিউটিং কেনো প্রয়োজন?
প্রথম কারণ হচ্ছে, ৩২ বিট অপারেটিং সিস্টেমের মেমরি অ্যাড্রেসিং সীমাবদ্ধতা অর্থাৎ এটি মাত্র ৪ গি.বা. মেমরি নিয়ে কাজ করতে পারে। অন্যদিকে তাত্ত্বিকভাবে ৬৪ বিট কল্পনাতীত ১৭.২ মিলিয়ন টেরাবাইট (TB) মেমরি অ্যাড্রেসিং করতে সক্ষম। প্রশ্ন উঠতে পারে, বেশি মেমরি কেনো আমাদের প্রয়োজন? এর অন্যতম কারণ- প্রোগ্রামার/ডেভেলপারদের স্বস্তি। কারণ, ডাটা হ্যান্ডল বা ম্যানিপুলেশনের জন্য তাদের প্রচুর অবকাশ থাকবে এবং এরা পারফরমেন্সের বা বটলনেকের সমস্যার জন্য চিন্তিত হবে না। থ্রিডি মডেলে বা উচ্চতর মিডিয়া সৃষ্টি অথবা মিউজিক উৎপাদনের কথা ভাবুন, ৩ গি.বা. বা ৪ গি.বা. এক্ষেত্রে বেশ অপ্রতুল। ফলে, প্রোগ্রামাররা তাদের মডেলকে খন্ড খন্ড করে ফেলতে বাধ্য হন, যা প্রচুর ডিস্ক সোয়াপিংয়ের জন্ম দেয়। ডিস্ক সোয়াপিং হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যখন পর্যাপ্ত র্যা্ম থাকে না বা ব্যবহার করা সম্ভব হয় না, তখন অপেক্ষাকৃত idle বা অলস প্রসেস/ডাটা হার্ডডিস্কের একটি নির্ধারিত অংশে জমা করে রাখা হয়। এবং প্রয়োজন সাপেক্ষে এগুলোকে র্যারমে লোড করা হয়। যেহেতু ডিস্ক সোয়াপিং (Swapping) বেশ ধীরগতির, ফলে পুরো প্রসেস বা প্রক্রিয়াটি স্লো হয়ে যায় অর্থাৎ পারফরমেন্সে ভাটা পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এটি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়।
৩২ বিট অ্যাপ্লিকেশনের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এটি সর্বোচ্চ ৩ গি.বা. ডাটা একক প্রসেসের জন্য ব্যবহার করতে পারে। এ কারণেই মাল্টিমিডিয়া কোম্পানি Pixar এবং Lucas Arts বিগত এক দশক ধরে তাদের থ্রিডি মডেলের পণ্য উৎপাদনের জন্য ৬৪ বিট লিনআক্স ব্যবহার করছে। এজন্য তারা বিশেষভাবে অটোডিস্কের ‘মায়া’ (Maya) অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করছে।
উচ্চতর কমপিউটিং
প্রকৌশল শিল্প ইতোমধ্যে ৬৪ বিটের সুবিধা উদঘাটন করে ফেলেছে। অটোডিস্কের Revit হচ্ছে এমন একটি অ্যাপ্লিকেশন, যা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের বিল্ডিংয়ের জটিল ডাটা মডেলিং সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এগুলোতে শত-সহস্র ডাটা পয়েন্ট যেমন-দেয়ালের পুরুত্ব, স্ট্রাকচারাল সংহতি (Integrity), বায়ু রোধ ইত্যাদি থাকতে পারে। শুধু তাই নয়, এসব ডাটা পয়েন্টের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত অজস্র ডাটা পয়েন্ট তৈরি হতে পারে, যা ৪ গি.বা. (সত্যিকার অর্থে ৩ গি.বা.) পরিসীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখা মোটেই সম্ভব হয় না। ফলে সমগ্র মডেলকে একত্রে মেমরিতে রাখা বা লোড করা সম্ভব হয় না। এর ফলে একটি বিল্ডিংকে বিভিন্ন সেকশনে বিভক্ত করতে বাধ্য হয়। যেমন Entrance (প্রবেশপথ), হল (Hallway), ছাদ (Roof) ইত্যাদি। একটি মডেলের ডাটা মডেল যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, তখন অন্য সেকশনের ডাটা ব্যবহার করতে সমর্থ হন না- একটাই কারণ মেমরি ধারণ করার উপায় নেই। অন্যদিকে ৬৪ বিট প্লাটফর্মে পুরো মডেলকে একবারে ধারণ করে পূর্ণাঙ্গভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভবপর হয়। এর ফলে উন্নত বিল্ডিং ডিজাইন তৈরি সহজতর হয়ে পড়ে।
গেম ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রেও ৩২ বিট পিসি পঙ্গু, তবে পুরোপুরি একই কারণে নয়। এক্ষেত্রে শত-সহস্র পিক্সেলের টেক্সচার মডেলের রেন্ডারিং মূলত দেয়া হয় GPU-এর মাধ্যমে। এক্ষেত্রে ডেভেলপারদের জন্য বাধা হচ্ছে তারা একসঙ্গে অনেক অ্যাপ্লিকেশন চালাতে পারেন না ৩২ বিট পিসিতে। অন্যদিকে ৬৪ বিট ওয়ার্কস্টেশনে এরা প্রয়োজনীয় টুলকিটসহ ব্রাউজার, ফটোশপ, ই-মেইল এবং পুরো গেম একত্রে চালু (Run) করতে পারেন অনায়াসে।
মোদ্দা কথা, ৬৪ বিটে নেই কোনো ডিস্ক-সোয়াপিং, নেই কোনো মন্থরতা অথবা সিস্টেম ক্র্যাশ (অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে)। সিস্টেম ক্র্যাশ কম হবার মূল কারণ হলো মেমরি অ্যাপ্লিকেশনের পর্যাপ্ততা। আরেকটি সুবিধা হলো একই পিসিতে মাল্টিপল ইনস্ট্যান্স অর্থাৎ একই গেম সফটওয়্যার কয়েকবার লোড করে মাল্টিপ্লেয়ার তথা একাধিক খেলোয়াড়ের প্রতিযোগিতা টেস্ট করার সক্ষমতা অর্জন করা।
তবে একটি কথা সত্যি, সাধারণ ব্যবহারকারী যারা মাইক্রোসফট ওয়ার্ড বা ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ব্যবহার করেন, তাদের জন্য ৬৪ বিট প্লাটফর্ম তেমন কোনো আহামরি বিষয় নয়। সম্ভবত এ কারণেই মাইক্রোসফট ৬৪ বিট অপারেটিং সিস্টেম বাজারে ছাড়লেও তাদের অফিস সুইট ২০০৭ ৩২ বিটে ছেড়েছে।
যে অস্বস্তি সহজে দূর হবার নয়
হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারের অসঙ্গতির কারণে ৬৪ বিট মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না। ধরা যাক, পেরিফেরাল ডিভাইসের কথা। কিছু নির্মাতা ৬৪ বিট ড্রাইভার নির্মাণ করলেও এখনও বিপুলসংখ্যক নির্মাতা ৬৪ বিট ড্রাইভার দিতে সক্ষম হয়নি। ৬৪ বিট অপারেটিং পরিবেশে ৩২ বিট ড্রাইভার একেবারে অচল। এর মূল কারণ উইন্ডোজের স্থাপত্যের সীমাবদ্ধতা। উইন্ডোজে ড্রাইভার, অপারেটিং সিস্টেম এবং হার্ডওয়্যারের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করে বিধায় এখানে সরাসরি Emulation সম্ভব হয় না। ফলে ৩২ বিট ড্রাইভার ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। যদিও ৩২ বিট অ্যাপ্লিকেশন Emulation পদ্ধতিতে ৬৪ বিটে চালানো সম্ভব কিন্তু ড্রাইভারে কিছুতেই নয়। ধরা যাক, ৩২ বিট মাইক্রোসফট অফিস ২০০৭। এটি ৬৪ বিটে Emulation পদ্ধতিতে কাজ করে। যদি ৩২ বিট ড্রাইভার Emulation পদ্ধতিতে চালু করা সম্ভব হতো, তাহলে ৬৪ বিট কমপিউটিং আজ সম্ভবত মূল স্রোতধারা হিসেবে স্থান করে নিতো। লাখ লাখ ডিভাইস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে ৬৪ বিটের ড্রাইভার তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে কাজটি সহজ হয়ে যেতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন।
৬৪ বিট বনাম মাল্টিকোর প্রসেসর
ডেভেলপারদের যদি বেছে নিতে বলা হয় কোনটি তারা পছন্দ করবে- ০১. ৬৪ বিট অ্যাপ্লিকেশন বা ০২. মাল্টিকোর স্থাপত্য। তাহলে এরা সানন্দে প্রথমটিকেই বেছে নেবে। কারণ, ০১. অ্যালগরিদম যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এরা ডবল প্রিসিশনে ব্যবহারে সক্ষম হবে। ০২. দীর্ঘস্থায়িত্ব গ্রাহকদের ক্রমান্বয়ে ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপ ৬৪ বিটের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে কয়েক বছরের মধ্যে।
এ বিষয়টি কয়েক বছর আগেও ভাবা যেত না যখন সব কিছু ৩২ বিটে পরিচালিত হতো। বর্তমানে মানুষের চিন্তাধারার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। আশার কথা, র্যা মের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এসে গেছে।
পরিসংহার
৬৪ বিট কমপিউটিং ধীরে ধীরে পরিপক্বতার দিকে এগুচ্ছে সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে অ্যাডোবির Creative Suite 4 একটি মাইলফলক হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। কারণ, এটি মূল স্রোতধারার প্রবেশের একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। এর পর পরই অটোডিস্কের মায়া ও রেভিট (Maya & Revit) এ আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছে। আশা করা যাচ্ছে, অচিরেই আমরা ৬৪ বিটের ড্রাইভার পেয়ে যাবো সব ডিভাইসের জন্য (কমপক্ষে ৯৫%), যা আমাদের সত্যিকারের প্রতিবন্ধকতাকে হটিয়ে দেবে। সফটওয়্যার নির্মাতারা ৬৪ বিট অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতে ইতোমধ্যে সাড়া দিচ্ছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদিও ৩২ বিটের সফটওয়্যার Emulation পদ্ধতিতে চালানো সম্ভব। প্রতি ঘরে ঘরে মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট, থ্রিডি গেমস বা মডেল যেভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে তাতে বুঝা যায়, ৬৪ বিট ক্রমান্বয়ে তাদের ঘরে স্থান করে নেবে। ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ নির্মাতারা এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবেন তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, তারা অত্যন্ত সুলভ মূল্যে ৬৪ বিট অপারেটিং সিস্টেম দিতে সক্ষম হবেন।
Saturday, March 27, 2010
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment