মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ৯/১১ - র বিপর্যরে পথ ধরে সারাবিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির বা আইটি খাতে মারাত্মক ধস নেমে এসেছিল৷ যারা এক সময় অন্য যেকোনো বিষয় বাদ দিয়ে কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংসহ তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে পড়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল, তারা ওই বিপর্যয়ের পর এই খাতটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়৷ স্বপ্নভঙ্গ হয় তাদের৷ বিশ্বের দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়ার জন্য আগ্রহী শিক্ষার্থী ক্রমাগত কমতে থাকে৷ ফলে এই খাতটিতে কাজ করার জন্য বিশেষজ্ঞ তৈরি হওয়াও প্রায় বন্ধের দিকে চলে যায়৷ কিন্তু সময়ের পথ ধরে এখন আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাত৷ নিত্যনতুন উদ্ভাবনা আর বাজার সম্প্রসারণের কারণে এখন এই খাতে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বিপুল জনশক্তি৷ আবার তৈরি হয়েছে রমরমা বাজার৷ নতুন স্বপ্ন৷ বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়৷ বিশেষজ্ঞদের ধারণা ২০১০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত পেশাজীবী সঙ্কটে পড়বে৷ সৃষ্টি হবে মারাত্মক বিপর্যয়৷ অর্থনীতিতে ধস আরো বাড়বে৷
সম্প্রতি দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়ে গেছে৷ কিন্তু উপযুক্ত কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে৷ তারা বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছে৷ গত ৫-৬ বছরে আইটি খাতে শিক্ষার্থীদের অনীহার কারণেই এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় বলে গবেষকরা মনে করছেন৷ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফুট পার্টনার্স তার রিপোর্টে বলেছে, চাকরিদাতারা আগে সনদপ্রাপ্ত দক্ষ কর্মীদের বেতন-ভাতার অতিরিক্ত হিসেবে যে বোনাস বা মূল বেতনের অংশ দিতো, এখন তারচেয়েও বেশি দিয়ে সংগ্রহ করতে হচ্ছে সনদপ্রাপ্ত নয় কিন্তু দক্ষ এমন প্রযুক্তিকর্মী৷ এন্টারপ্রাইজ অ্যাপ্লিকেশনস, ই-কমার্স এবং প্রসেস ম্যানেজমেন্টের মতো কর্মক্ষেত্রগুলোতে এ অবস্থা চলছে৷ ফুট পার্টনার্স গত ৮ বছর ধরে প্রতি ৩ মাস অন্তর চাকরিদাতাদের ওপর জরিপ পরিচালনা করে আসছে৷
ফুট পার্টনার্স-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রধান গবেষক ডেভিড ফুট বলেছেন, সনদপ্রাপ্ত এবং সনদপ্রাপ্ত নয় এমন আইটিকর্মীদের মধ্যে গড় বেতন-ভাতার অতিরিক্ত বোনাস বা বেসিক বেতনের অংশের ব্যাবধান খুব বেশি নয়৷ বর্তমানে সনদপ্রাপ্ত নয় এমন প্রযুক্তি কর্মীদের বেতন-ভাতার অতিরিক্ত অংশ বেড়েছে আগের চেয়ে গড়ে ৮ দশমিক ০৮ শতাংশ৷ অন্যদিকে সনদপ্রাপ্ত প্রযুক্তিকর্মীদের গড় বৃদ্ধি ৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ৷ কর্মীর নির্দিষ্ট কাজের দক্ষতার জন্যই অতিরিক্ত ওই অর্থ দেয়া হয়৷ এই পরিস্থিতি সনদপ্রাপ্ত কর্মীদের কাছে অবশ্যই কাম্য নয়৷ কারণ এরা অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় করে ওই সনদ অর্জন করেছেন৷ ফলে তাদের প্রত্যাশা অবশ্যই অন্যদের চেয়ে বেশি৷ কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না এই খাতে দক্ষ কর্মীর সঙ্কট থাকায়৷
ডেভিড ফুট বলেছেন, আইটি খাতে প্রচুর প্রবৃদ্ধি হওয়ায় গত ২ বছর ধরে দক্ষ কর্মীসঙ্কট লেগেই আছে৷ আর তাই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসায় বাণিজ্য ধরে রাখতে সনদপ্রাপ্ত নয় এমন আইটিকর্মীদের বেশি বেতন-ভাতায় নিয়োগ দিতে বাধ্য হচ্ছে৷ বিশ্বের বহু দেশ সনদহীন দক্ষ আইটিকর্মীও প্রয়োজনমতো সংগ্রহ করতে পারছে না৷ এই অবস্থা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি মনে করছেন৷
ডেভিড ফুট বলেন, একটা সময় ছিল যখন চাকরিদাতারা প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা এবং লাভজনক অবস্থা ধরে রাখতে সনদপ্রাপ্ত আইটিকর্মীদের অনেক বেশি বেতন-ভাতা দিয়ে সংগ্রহ করার দিকেই জোর দিতো৷ কিন্তু গত দুই বছর বা তার চেয়েও কিছু বেশি সময় ধরে বিভিন্ন কোম্পানি নতুন আইটিপণ্য উদ্ভাবন, লাভ ও বিক্রি বাড়ানো, গ্রাহক সেবা এবং সম্পর্ক উন্নয়নের দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেছে৷ এরা মনে করছে, এ কাজের জন্য তাদের সনদপ্রাপ্ত কর্মী আবশ্যক নয়৷ প্রয়োজন দক্ষ কর্মী সংগ্রহ৷ প্রতিষ্ঠানগুলোর এই ফোকাস পরিবর্তন আইটি পেশায় একটি মিশ্র অবস্থার সৃষ্টি করেছে৷ ফুট বলেন, আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ডাটা সেন্টার নিয়ে নেই, একই সাথে তার রয়েছে লাইন অব বিজনেস, বিজনেস ইউনিট এবং ব্যবহারকারীদের কাছাকাছি পৌঁছার উইং বা শাখা৷ তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর উপযুক্ত কারিগরি জ্ঞানেরও প্রয়োজন রয়েছে৷ এন্টারপ্রাইজ বিজনেস অ্যাপ্লিকেশনে জ্ঞান রয়েছে এমন কর্মীরা এখন বেতন-ভাতার অতিরিক্ত ৯ দশমিক ১ শতাংশ প্রিমিয়াম পাচ্ছে৷ এক বছর আগে এই হার ছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ৷ সনদহীন ক্যাটাগরির অন্য আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট ওয়েব, ই-কমার্স এবং ডাটাবেজ৷ ম্যানেজমেন্ট এবং প্রসেসে কর্মীরা এখন প্রিমিয়াম পাচ্ছে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, আগে ছিল ৮ দশমিক ৫ শতাংশ৷ ২০০৫ সালে সনদহীন আইটি কর্মীদের প্রিমিয়াম যেখানে ছিল গড়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, চলতি বছর তা দাঁড়িয়েছে গড়ে ৮ দশমিক ০৮ শতাংশে৷ কোনো খাতে প্রিমিয়ামের হার আরো বেশি৷ তবে কমেছে সনদপ্রাপ্ত আইটিকর্মীদের প্রিমিয়ামের হার৷ ২০০৫ সালে যেখানে এদের প্রিমিয়াম ছিল ৮ দশমিক ২৬ শতাংশ, সেখানে চলতি বছরের তৃতীয় কোয়ার্টারে তা দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯৭ শতাংশে৷
যুক্তরাষ্ট্রে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সম্প্রসারণের কারণে সেখানে আইটি খাতে এক বছর আগের চেয়ে চাকরির সুযোগ বেড়েছে ৬ শতাংশ৷ ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিস্টিকস সূত্রে এ তথ্য দিয়েছে৷ চাকরির সবচেয়ে বেশি সুযোগ রয়েছে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কমপিউটার সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড সিস্টেমস এনালিস্ট এবং আইএস ম্যানেজার পদে৷ দুইটি ক্যাটাগরিতে চাকরির সুযোগ কমেছে৷ এগুলো হলো প্রোগ্রামার এবং সাপোর্ট স্পেশালিস্ট৷ যেভাবে এই খাতটি এগিয়ে চলেছে তাতে ধারণা করা যায়, আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর আইটিকর্মীর প্রয়োজন হবে৷
এদিকে সারা বিশ্বে কমপিউটার প্রযুক্তি ব্যবসায় অনেক বেড়েছে৷ বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি পর্যালোচনা করে এ ব্যাপারে রিপোর্ট দিয়েছে বিশ্বখ্যাত টেকনোলজি মার্কেট ইন্টেলিজেন্ট ফার্ম ইন্টারন্যাশনাল ডাটা করপোরেশন তথা আইডিসি৷ এরা ৮২টি দেশ এবং অঞ্চলের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছে৷ এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কমপিউটার হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও সার্ভিস৷
আইডিসির সমীক্ষা থেকে বেরিয়ে এছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে আইটি খাত৷ এর গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে৷ প্রায় ১০ লাখেরও বেশি কোম্পানি সারা বিশ্বে কমপিউটার ব্যবসায়ের সাথে জড়িত৷ এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে প্রায় ৩ কোটি ৫২ লাখ কর্মী৷ বিশ্বব্যাপী আইটি বাজারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই নিয়ন্ত্রণ করছে জাপান, কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র৷ কমপিউটার হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং সার্ভিসে সিঙ্গাপুর, সুইডেন এবং ডেনমার্কে জিডিপির হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ৷ সমীক্ষায় বলা হয়, আগামী ৪ বছরে কমপিউটার শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে ৭১ লাখ৷ চীনে সবচেয়ে বেশি কর্মী নিয়োগ দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ এসময় বিশ্বব্যাপী গড় চাকরির অনুপাতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চাকরির সুযোগ হবে তিনগুণ বেশি৷
উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে৷ অদক্ষ নয় বরং দক্ষ কর্মীদেরই চাহিদা হবে তুঙ্গে৷ ২০১১ সালের মধ্যে সফটওয়্যার সংক্রান্ত নতুন চাকরির সংখ্যা হবে প্রায় ৪৬ লাখ৷ এদের মধ্যে ১২ লাখ কর্মীর চাকরি হবে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং মেক্সিকোতে৷ আজারবাইজানেও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে৷
মাইক্রোসফটের প্রধান রিসার্চ এবং স্ট্র্যাটেজি কর্মকর্তা ক্রেইগ মানডি সম্প্রতি এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, বিশ্বের সব দেশের চাকরি বাজারেই আইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে৷ এই অবস্থা আগামীতে আরো জোরদার হবে৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতেও তথ্যপ্রযুক্তিকর্মীর চাহিদা বাড়ছে৷ নতুন নতুন আইটি বিশেষজ্ঞ তৈরি অব্যাহত না থাকলে সেখানের দেশগুলোও মারাত্মক কর্মী সঙ্কটে পড়বে৷ এ অবস্থা মোকাবেলায় ইউরোপীয় দেশগুলো এখনই নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে৷ তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে সেখানের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো৷ আগামী বছরগুলোতে ইউরোপে ঠিক কি পরিমাণ প্রযুক্তিকর্মীর চাহিদা সৃষ্টি হবে, তা নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান হাজির করা না গেলেও চাহিদা যে অনেক বেশি হবে, তা নিশ্চিত করেছেন সেখানের আইটি বিশেষজ্ঞরা৷ এখনই সেখানে ৬০ লাখ কর্মীর প্রয়োজন রয়েছে৷
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অবস্থাটা কি হবে সে ব্যাপারে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা সাম্প্রতিক একটি প্রবন্ধ এবং কমপিউটার জগৎ-এর গোলটেবিল বৈঠকে উঠে আসা আলোচনা থেকে৷
একটি দৈনিকে লেখা প্রবন্ধে জাফর ইকবাল লিখেছেন, সবারনিশ্চয়ই মনে আছে, একটা সময় ছিল যখন সবাই বলত তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে এই দেশ অর্থনৈতিকভাবে মাথা উঁচু করে ফেলবে৷ এদেশের সব ছেলেমেয়ে তখন পাগলের মতো কমপিউটার সায়েন্স পড়তে এসেছে৷ যে ছেলে গণিত বা বিজ্ঞান পড়ে বিশ্বনন্দিত গণিতবিদ বা বিজ্ঞানী হতে পারত, সেও এসেছে কমপিউটার সায়েন্স পড়তে৷ যে কারণেই হোক এদেশে সফটওয়্যার কোম্পানি সেভাবে গড়ে ওঠেনি, মাঝখান থেকে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো এসে রমরমা ব্যবসায় করছে৷
মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করা এখন এই দেশের ছেলেমেয়েদের জীবনের লক্ষ্য, যারা এক সময় কমপিউটার সায়েন্স পড়েছে, তারা এখন পাগলের মতো টেলিকম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ছুটছে৷
অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি কিন্তু থেমে থাকেনি, সেটি নিজের মতো করে এগিয়ে যাচ্ছে৷ দেশে কিংবা দেশের বাইরে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োজন একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে৷ কিন্তু কমপিউটার সায়েন্স বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের উত্সাহ হঠাৎ কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটা ভয়াবহ শূন্যতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ এ বিষয়গুলোয় ছাত্র ভর্তি কমে যাওয়ার কারণে যে সমস্যাটি তৈরি হবে, সেটা আমরা টের পাব আজ থেকে কয়েক বছর পর৷ মোটামুটিভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়, এই ব্যাপারে যদি কিছু করা না হয়, তাহলে আজ থেকে কয়েক বছর পর ভারত থেকে প্রযুক্তিবিদ এনে আমাদের কাজগুলো করাতে হবে৷ আমরা আমাদের জনশক্তি তৈরি করার আগেই সেটা শেষ করে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছি৷
এটা এক ধরনের ক্রান্তিকাল৷ এদেশের সফটওয়্যার শিল্পের কর্ণধাররা সত্যিই যদি মনে করেন এই দেশে শিল্পটি এখন গড়ে উঠতে শুরু করেছে, তারা যদি মনে করেন তাদের বিশাল একটা জনশক্তির দরকার, তাহলে দেশের মানুষকে সেটা বলতে হবে৷ পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতে হবে, এটা নিয়ে সেমিনার-ওয়ার্কশপ করতে হবে৷ দেশের প্রাইভেট আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করতে হবে৷ তারা যদি সেটা না করেন, তাহলে আজ থেকে কয়েক বছর পর আমাদের মাথা চাপড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না৷
সম্প্রতি কমপিউটার জগৎ আয়োজিত কমপিউটার বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক থেকেও এ বিষয়ে উঠে এসেছে নানা তথ্য৷
ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চেয়ারপার্সন সৈয়দ আক্তার হোসেন বলেছেন, ২০০২ সালের পর থেকে তিনি প্রতি সেমিস্টারেই দেখছেন, ছাত্রছাত্রীদের ভেতর আগে কমপিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করার পেছনে যে আগ্রহ কাজ করতো, সেটা হঠাৎ কমতে শুরু করে৷ আমরা তাদের সামনে দেখাতে পারছি না যে, কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে লেখাপড়া করে চাকরি পাওয়ার অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে৷ তিনি বলেন, আমরা দেখেছি ই-গভর্নেন্স নিয়ে সরকারের আইসিটি খাত, বিশেষ করে আইসিটি টাস্কফোর্স এবং সেখান থেকে এসআইসিটি প্রকল্পের আওতায় ৫১টি বা তারও বেশিসংখ্যক প্রকল্পে পরিকল্পনা যেভাবে নেয়া হলো, এই প্রকল্পগুলোর ব্যস্তবায়ন এবং তার পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য যে পরিমাণ লোকবল দরকার সে পরিমাণ লোকবল বর্তমানে আমাদের বাজারে নেই৷ আমাদের ভর্তিচ্ছুদের সংখ্যা যেহারে কমছে, তাতে ভবিষ্যতে আমরা কোনোভাবেই এগুলোকে সক্রিয় করতে পারবো না৷ আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই ই-গভর্নেন্সের কথা ভেবে থাকি, তাহলে কিভাবে এই সেক্টরে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে আগ্রহী হয়, কিভাবে নতুন প্রজন্মকে আরেকটু দিকনির্দেশনা দিয়ে, নজর দিয়ে এ বিষয়ের প্রতি মনোযোগী করে তোলা যায়, সে ব্যাপারে কাজ করা আমাদের একটা নৈতিক কর্তব্য৷ গোলটেবিল বৈঠকের অন্যান্য বক্তার কাছ থেকেও প্রায় অভিন্ন বক্তব্য বেরিয়ে আসে৷
আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি৷ ছাত্রছাত্রীদের কমপিউটার সায়েন্স পড়তে আগ্রহী করে তুলতে হবে৷ তাদেরকে বুঝতে হবে আন্তর্জাতিক চাকরির বাজার তো বটেই, দেশেও তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশ ঘটায় তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারেও চাহিদা বেড়ে চলেছে৷ তাই নিজেকে এ খাতে দক্ষ করে গড়ে তোলার মাধ্যমে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে হবে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. মো: লুত্ফর রহমান বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার সায়েন্সের ছাত্রছাত্রীরা কখনোই নিরাশ নয়৷ তাদের কর্মসংস্থানের হার শতকরা ১০০ ভাগ৷ ডিগ্রি শেষ করার আগেই তাদের চাকরি হয়ে যায়৷ তবে একথা সত্য যে, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের হার ক্রমাগত নেমে গেছে৷ এর একটা কারণ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানে যেসব আইটি বিশেষজ্ঞ দরকার তার অনেকটাই বিবিএ গ্র্যাজুয়েটদের দিয়ে পূরণ করা যায়৷ ফলে বিবিএ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, কমেছে কমপিউটার সায়েন্সে৷ টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরটিও এখন বেশ বড় এবং সেদিকেও অনেক ছাত্রছাত্রী যাচ্ছে৷ সেটাও একটা ব্যাপার৷
তিনি বলেন, ২০১০ সালে আইটি শ্রমিকদের যে অভাব দেখা দেবে বলা হচ্ছে তা সঠিক৷ এখন যারা পড়াশোনা করে গ্র্যাজুয়েট হবে অর্থাৎ চাকরির বাজারে আসবে তাদের চাহিদা বেশি হবে৷ এরা ভালো বেতনে ভালো চাকরি পাবে৷ ফলে কমপিউটার বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে বলে তিনি আশাবাদী৷ এই খাতে অনেক ধরনের কাজের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে এবং এটা ত্বরান্বিত হচ্ছে৷ ফলে আশা করা যায়, সামনের বছরগুলোতে এই খাতে ভালো অবস্থা তৈরি হবে৷ লুত্ফর রহমান বলেন, এই খাতে দুটি বিষয় দরকার৷ একটি মেধা এবং অন্যটি পরিশ্রম৷ এখানে অলসতার সুযোগ নেই৷ এখন যারা কমপিউটার বিজ্ঞানে পড়াশোনা করতে আসছে তারা মেধাবী, গণিতে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে৷ সুতরাং একটা ভালো অবস্থার দিকে আমরা যাচ্ছি৷
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment