সার্চ ইন্ঞ্জিন:
আজকের এই ইন্টারনেটে আপনি যেকোন একটি সার্চ ইন্ঞ্জিনে "বারাক ওবামা" লিখে সার্চ দিন। আমি নিশ্চিৎভাবে বলতে পারি আপনি বারাক ওবামা সম্বন্ধে যা যা জানতে চান তার অধিকাংশ তথ্যই পেয়ে যাবেন। যে প্রযুক্তির বলে সার্চ ইন্ঞ্জিনগুলো প্রায় ১৫৬ মিলিয়নের বেশি ওয়েবসাইট আর বিলিয়ন বিলিয়ন ওয়েবপেইজের মধ্য থেকে আপনার প্রয়োজনীয় তথ্যটি প্রায় নিখুঁতভাবে খুঁজে এনে দেয় তা অনেকটা বিস্ময়করই বটে! প্রযুক্তি বিস্ময়কর হতে পারে, কিন্তু এই বিস্ময়কর প্রযুক্তির ওপর আজ আমরা যে পরিমাণে নির্ভরশীল তা কিন্তু মোটেও বিস্ময়কর নয়। প্রায়শঃই আমরা ভুলে যাই যে মাত্র ১১ বছর আগেও ইন্টারনেটে ওয়েবপেইজগুলো পূর্ণ ছিলো লাইনের পর লাইন শুধু লেখা আর লেখা দিয়ে, ছিলোনা গুগোলের মতো সার্চ ইন্ঞ্জিন। আর তারও ৫ বছর আগে ইন্টারনেটে ছিলোনা সার্চ নামক কোন বস্তু। ইন্টারনেটে আপনি যা চাইছেন তা খুঁজে পাওয়া ছিলো প্রায় অসম্ভবের ধারে কাছে। সর্বোচ্চ যা করা সম্ভব ছিলো তা হলো লিংকের পর লিংক ক্লিক করে যাওয়া, আর আশা করা যে, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় তথ্যটি পেয়ে যাবেন।
এ শুধু সার্চ ইন্ঞ্জিনের গল্পগাঁথা নয়, এ এক রোমাঞ্চকর ইতিকথা যার প্রতিটি মুহূর্ত আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবে সেইসব কৃতি মানুষদের কথা, আধুনিক ইন্টারনেটের বিকাশে যাদের ভূমিকা আর অবদান কখনোই ভোলবার নয়।
সিলিকন ভ্যালির নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সান ফ্রান্সিসকো শহরের দক্ষিণ দিকের একটি অংশই হলো সিলিকন ভ্যালি। সিলিকন ভ্যালির "সিলিকন" শব্দটি এসেছিলো ভ্যালিতে অবস্থিত জগদ্বিখ্যাত সব সিলিকন চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে। তবে এখন অবশ্য "সিলিকন" শব্দটা ভ্যালির সামগ্রিক রূপকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। আর কেনই বা হবে না? সিলিকন ভ্যালিতে অবস্থিত Adobe, Apple Inc, eBay, Google, Hewlett-Packard (HP), Intel, Nvidia, Oracle, Yahoo!, Advanced Micro Devices (AMD) Symantec, Sun Microsystems, Asus, Facebook, McAfee, Opera Software, Siemens, Sony প্রভৃতি বিখ্যাত সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সদরদপ্তর। সিলিকন ভ্যালি হচ্ছে পৃথিবীর সব টেকিদের (Techie-টেকনোলজি সংক্রান্ত কর্মকান্ডে জড়িত ব্যক্তি) কাছে স্বপ্নের জগৎ। এখানে মেধার মূল্য অনেক। এখানে একটি ভালো আইডিয়া পেলে তার জন্য টাকা ঢালার জন্য মুখিয়ে আছেন সব ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা (Venture Capitalist-নবীন কিন্তু সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারী)। মেধা, আইডিয়া আর কর্মদক্ষতার এমন মূল্যায়ন পৃথিবীর আর কোথাও হয় কিনা সন্দেহ। কিন্তু এই সিলিকন ভ্যালির বিখ্যাত সব আইডিয়াগুলোর কেন্দ্র বা উৎস কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠান নয়, বরং তা হলো স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি। আর এই স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকেই ইন্টারনেটে আধুনিক সার্চ ব্যবস্থার পদযাত্রার শুরু।
জেরি ইয়াং ও ডেভিড ফাইলো
১৯৯৪ সালের কথা। এই স্ট্যানফোর্ডেরই দু'জন ছাত্র ছিলেন জেরি ইয়াং (Jerry Yang) আর ডেভিড ফাইলো (David Filo) । তাদেরই এক প্রফেসর যখন ১ বছরের জন্য ছুটিতে চলে যান, জেরি আর ডেভিড সেই প্রফেসরের কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যান। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে করতে নিজের অজান্তেই জেরি আর ডেভিড এমন একটি আইডিয়া পেয়ে যান যা ছিলো সার্চ ব্যবস্থার প্রথম পদক্ষেপ। আজ জেরি আর ডেভিডের নিজস্ব একটি কোম্পানী আছে: ইয়াহু!(Yahoo!) , যা পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ও দ্বিতীয় বৃহত্তম সার্চ ইন্ঞ্জিন। আর এসব কিছুর শুরু তখন যখন জেরি ও ডেভিড স্ট্যানফোর্ড ফ্যান্টাসি বাস্কেটবল লীগ জেতার জন্য ইন্টারনেটকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সে উপায় খুঁজছিলেন। ফ্যান্টাসি বাস্কেটবল লীগ প্রকৃতপক্ষে কোন বাস্কেটবল লীগ নয় বরং এটিকে বলা যেতে পারে একধরনের ভার্চুয়াল প্রতিযোগিতা। এতে কিছু বাস্তব খেলোয়াড়ের নামের সমন্বয়ে একটি বাস্কেটবল টিম গঠন করতে হতো ও সেই টিমটি নিবন্ধন করতে হতো। অতঃপর টিমের খেলোয়াড়রা বাস্তব বাস্কেটবল ম্যাচে যে পয়েন্ট অর্জন করতো তা দিয়ে ফ্যান্টাসি বাস্কেটবল লীগের প্রতিটি দলের মোট পয়েন্ট নির্ধারিত হতো। এক্ষেত্রে সাফল্যের মূলমন্ত্র ছিলো, ভালো খেলোয়াড় নির্বাচন করা এবং ফর্মে থাকা খেলোয়ারকে দ্রুত দলে নিয়ে আসা ও ফর্মহীন খেলোয়াড়দেরকে দল থেকে অপসারণ করা। আর এই কাজটি যে দল আর সবার আগে করতে পারতো স্বভাবতই তারাই সাফল্য পেতো। অন্যান্য টিম যেখানে পরদিনের সংবাদপত্রের পাতা ঘেঁটে ম্যাচের স্কোর জেনে তারপর দলে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতো, জেরি আর ডেভিড পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলেন না। তারা চাইলেন কিভাবে তার আগেই ম্যাচের রাতেই তারা এ কাজটি আর সবার আগে করে ফেলতে পারেন। আর এজন্যে তারা শরনাপন্ন হলন ইন্টারনেটের। ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে ঘেঁটে তারা সাম্প্রতিকতম স্পোর্টস নিউজ সন্ধান করতেন। ফলাফল স্বরূপ তারা স্ট্যানফোর্ড ফ্যান্টাসি বাস্কেটবল লীগ জিতেও নেন।
আপনি হয়তো ভাবছেন: "সবই তো বুঝলাম কিন্তু এর সাথে সার্চের কি সম্পর্ক?" সম্পর্ক আছে। এভাবে ঘেঁটে ঘেঁটে তথ্য বার করতে গিয়ে জেরি আর ডেভিড বুঝতে পেরেছিলেন ইন্টারনেটে কোন নির্দিষ্ট তথ্য খুঁজে বের করা কতোটা কষ্টসাধ্য। আর তাই তারা এজন্য কোন সহায়ক ওয়েবসাইটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। আর এভাবেই ইয়াহুর যাত্রাটা শুরু হয়। কিন্তু তখনকার ইয়াহুর সাথে আজকের আধুনিক সার্চ সিস্টেমের কোন মিল ছিলো না। তখনকার ইয়াহু ছিলো বিভিন্ন ক্যাটাগরি আর সাব-ক্যাটাগরিতে বিভক্ত যাতে মাত্র দুইজন মানুষ মিলে দিনের পর দিন ধরে অসংখ্য ওয়েবসাইটকে নিজের হাতে তালিকাবদ্ধ করেছেন। একদিনে যতোগুলো ওয়েবসাইট তালিকাবদ্ধ করা সম্ভব করতেন। এ কাজটা শুনলে যতোটা সোজা মনে হয় আসলে ছিলো তার চাইতে অনেক অনেক কঠিন ও ক্লান্তিদায়ক। কারন হাজার হোক তারা তো মানুষ, কতো ধকলই বা সইবেন তারা! ধীরে ধীরে ইয়াহু ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলো ওয়েব ব্যবহারকারীদের মধ্যে। একদম প্রথমে ইয়াহুর নাম কিন্তু ইয়াহু ছিলো না। এর নাম ছিলো - "Jerry's Guide to the World Wide Web"। পরবর্তীতে একটু চটকদার নাম রাখার উদ্দেশ্যে "ইয়াহু (Yahoo)" নামটি নির্বাচন করা হয়। সাইটে দৈনিক ভিসিটের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছিলো হু হু করে। ইয়াহুর আইডিয়া ছিলো একটি অসাধারণ আইডিয়া এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধুমাত্র একটি ভালো আইডিয়ার বলে কোন ভালো কোম্পানী গড়ে ওঠে না, এ জন্য প্রয়োজন হয় টাকার.......অনেক অনেক টাকার। কিন্তু যেমনটা সবাই জানে, সিলিকন ভ্যালিতে টাকার কোন অভাব নেই। আর অভাব নেই ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের। এরা সেই ব্যাক্তি যাদের দ্বারানির্ধারিত হয় কোন স্টার্টআপটি টিকে থাকবে আর কোনটি থাকবে না। এই ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদেরই বিখ্যাত একজন মাইকেল মরিজ (Michael Motitz) ইয়াহু!তে সর্বপ্রথম বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। প্রাথমিক পর্যায়ে মরিজ নিজেও ইয়াহুর সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, কিন্তু সর্বোপরি ইয়াহুর চমকপ্রদক আইডিয়াটিই নিঃসন্দেহে তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। কেননা মরিজ জানতেন যে, ইয়াহু হচ্ছে এমন একটি সেবা যা মানুষকে সেসব তথ্য খুঁজে পেতে সহায়তা করছে যা অন্যথা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব এবং একরকম নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করছে। এমন একটি জিনিষের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়াটাই স্বাভাবিক।
মরিজ প্রাথমিকভাবে ইয়াহুর পেছনে ২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। তাতে করে ইয়াহুর টাকা নিয়ে চিন্তাটা সাময়িকভাবে দূর হলেও জেরি ও ডেভিড জানতেন যে সমস্যার মাত্র শুরু হয়েছে। কারন এতো এতো ব্যবহারকারী আর জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও ইয়াহুর নিজের কোন আয় ছিলোনা। কিভাবে ইয়াহু থেকে কিভাবে টাকা আয় করা যায় সে বুদ্ধিও কারো জানা ছিলো না। আসলে শুধু ইয়াহু না, সেই সময়ে কারোরই জানা ছিলোনা ইন্টারনেটে টাকা আয় করার কোন কৌশল।
অবশেষে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় একটি মাত্র শব্দে, আর তা হলো- "বিজ্ঞাপণ"। আসলে পৃথিবীর আর সবগুলো তথ্য প্রচার মাধ্যমের মতোই ইন্টারনেটও বিজ্ঞাপণের জন্য ব্যবহৃত হবে তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে? যখন অনেক সংখ্যক লোক একই জায়গায় জড়ো হয় সেখানে একটি বিজ্ঞাপণের ক্ষেত্র তৈরি হয়, এর চাইতে বেশি মাথা খাটাবার প্রয়োজন বিজ্ঞাপণওয়ালাদের ছিলো না। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। এই বিজ্ঞাপণের ইস্যুতে পুরো ওয়েব কমিনিউটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। একদিকে ছিলো ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট আর ব্যবসায়ীরা যারা ওয়েব থেকে উপার্জনে বিজ্ঞাপণের কোন বিকল্প নেই বলে বিশ্বাস করতেন। আর এক দিকে ছিলেঅ ওয়েবের বিশুদ্ধবাদী বা মৌলবাদীরা যারা বিশ্বাস করতেন এভাবে ইন্টারনেটকে বিজ্ঞাপণের প্রচারণায় ব্যবহার করা হলে ইন্টারনেট তার নিজস্বতা ও বিশুদ্ধতা হারাবে। আসলে বিজ্ঞপণ দেয়ার ব্যাপারটা নিয়ে জেরি আর ডেভিডরা নিজেরাও শঙ্কিত ছিলেন। তারা ভেবেছিলেন এভাবে বিজ্ঞাপণ দেয়ার ফলে তাদের সাইট ব্যবহারকারীরা রুষ্ট হবেন এবং তারা বিদ্রোহ করবে। আর তাই এক অদ্ভূত উভয় সংকটে পড়েন ইয়াহুর তরুন উদ্ভাবকদ্বয়। কিন্তু ইয়াহুর আর কিইবা করার ছিলো? সাইট চালাতে হলে যে টাকার প্রয়োজন তা একমাত্র বিজ্ঞাপণের মাধ্যমেই আয় করা সম্ভব। ১৯৯৫ এর শেষের দিকে ইয়াহু প্রথমবারের মতো বতাদের সাইটে ব্যানার এ্যাড (Banner Ad) দেয়া শুরু করে। ইয়াহু কর্তৃপক্ষের সব আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে বিজ্ঞাপণ দেয়ার পরও তাদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমার বদলে বেড়েই যেতে থাকে।
ইন্টারনেটের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইয়াহু প্রমাণ করে দেখালো যে ইন্টারনেট থেকেও টাকা আয় করা সম্ভব। এই যুগান্তকারী ঘটনার ফলাফল যা হবার তাই হলো। ওয়েব বাণিজ্যিকরণের যুগ শুরু হলো। ১৯৯৫ সাল নাগাদ ইয়াহুর প্রতিদ্বন্দীর সংখ্যা বাড়তে লাগলো। আসলো ইনফোসিক (Infoseek) , আলটাভিসতা (AltaVista) , লাইকোস (Lycos) মতো সার্চ প্রোভাইডার। কিন্তু সম্ভবত ইয়াহুর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দী ছিলো এক্সাইট (Excite) নামের একটি কোম্পানী। ইয়াহুর মতোই এক্সাইটও ছিলো কিছু স্ট্যানফোর্ড পড়ুয়া ছাত্রদের উদ্ভাবন। কিন্তু যদি প্রশ্ন ওঠে সার্চ টেকনোলজি নিয়ে তবে বলতেই হবে যে এক্সাইট এদিক দিয়ে ইয়াহুর চাইতে অনেক অনেক উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করছিলো। ইয়াহুর মতো মানব সহায়তায় অসংখ্য ওয়েবসাইট তালিকাভুক্ত ও ক্যাটাগরি/সাবক্যাটাগরিতে বিভক্তকরণের বদলে এক্সাইট যা লিখে সার্চ দেয়া হয়েছে তা যে যে ওয়েবপেইজে আছে তা খুঁজে বের করতো। আরেক কথায় এক্সাইট ছিলো একটি পুরোমাত্রার সফটওয়্যার। আজ আমরা সার্চ বলতে যা বুঝি তার শুরুটা হয়েছিলো এভাবেই। ১৯৯৭ সাল নাগাদ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এতোই বেড়ে গেলো যে ইয়াহু ও এক্সাইটের মতো সাইটগুলো এক অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন ফিচার যোগ করছিলো। কেউ পার্সোনালাইজেশন ফিচার দেয়তো কেউ মেইল সার্ভিস দেয়। সার্চ ওয়েবসাইটগুলো দৃঢ় প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলো যাতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সকল চাহিদা তারা একটি সাইটেই পূরণ করতে পারে। কিন্তু এতো চাহিদা মিটাতে গিয়ে সাইটগুলো সার্চের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে এবং বেমালুম ভুলেই যায় যে এই সার্চের বদৌলতেই একসময় তাদের উত্থান ঘটেছিলো।
সোজাসুজি বলতে গেলে, জাঁকজমক আর চাকচিক্যের জোয়ারে গা ভাসানো ইয়াহু আর এক্সাইটের মতো সাইটগুলো সেখানেই তাদের সার্চ সিস্টেমকে কবরচাপা দিয়েছিলো। বেশিরভাগ সময়ই সার্চ রেজাল্টগুলোতে থাকা লিংকগুলো ব্যবহারকারীদেরকে নিয়ে যেতো কোন বিজ্ঞাপনী ওয়েবসাইটে। আর তাই সদা সম্প্রসারণশীল ইন্টারনেট ভুবনে কোন তথ্যের নিশ্চিৎ অবস্থান খুঁজে বের করার আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে বেড়েই চলেছিলো
ল্যারি পেইজ
সের্গেই ব্রিন
আর এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের উদ্দ্যোগটা এলো বরাবরের মতোই স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির দুই ছাত্রের কাছ থেকেই - ল্যারি পেইজ (Larry Page) ও সের্গেই ব্রিন (Sergey Brin) । এবং আবারো প্রতিষ্ঠানের সামটা ছিলো সংক্ষিপ্ত ও চটকদার - গুগোল (Google)। গুগোল শব্দটির অর্থ হচ্ছে ১০^১০০। অর্থাৎ ১০ এর ১০০তম ঘাততে গাণিতিক ভাষায় সংক্ষেপে গুগোল বলা হয়। ল্যারি পেইজ ও সের্গেই ব্রিন এর মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৯৬ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি আয়োজিত ভবিষ্যৎ গ্র্যাজুয়েটদের জন্য সান ফান্সিসকোর এক ভ্রমণ ক্যাস্পে। সেই ভ্রমণ ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন ল্যারি পেইজ যিনি অতি শীঘ্রই স্ট্যানফোর্ড থেকে তার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করতে যাচ্ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো পেইজের শখ ছিলো লেগো থেকে ইন্কজেট প্রিন্টার বানানো। এই ল্যারি পেইজের নীতির উপর ভর করেই আজকের গুগোলের উত্থান ঘটেছিলো।
এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে, কি এমন বিশেষত্ত্ব ছিলো এই নতুন সার্চ ইন্ঞ্জিন গুগোলে যা একে আলাদা করেছিলো আর ১০টা সার্চ ইন্ঞ্জিন থেকে? সোজা কথায় বলতে গেলে গুগোল কোন ওয়েবপেইজ বা ওয়েবসাইটের গুরুত্ব নির্ধারণে এক সম্পূর্ণ নতুন কিন্তু বেশ সরল একটি পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলো। এই নীতি অনুযায়ী, যদি কোন ওয়েবপেইজে আরেকটি ওয়েবপেইজের লিংক উল্লেখিত থাকে এবং কোন ব্যবহারকারী যদি ঐ লিংক অনুসরণ করে উক্ত ওয়েবপেইজে যান তবে তা এক ধরনের রেকোমেন্ডেশন হিসেবে কাজ করে। এক্ষত্রে দ্বিতীয় ওয়েবপেইজের জন্য প্রথম ওয়েবপেইজের রেকোমেন্ডেশনকে একটি ভোট হিসেবে গণ্য হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, ধরুন আব্রাহাম লিংকন সম্বন্ধীয় একটি ওয়েবসাইট এরকম ১৫ মিলিয়ন ভোট পেয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরেই নেয়া যেতে পারে উক্ত ওয়েবসাইটটিকে অনেকের কাছেই দরকারী হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। আরেকটি ওয়েবসাইট ধরুন যা এরূপ ১৫টি ভোট পেয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই খুব বেশি মানুষের জন্য উপকারী সাব্যস্ত হয়নি। ওয়েবপেইজের গুরুত্ব নির্ধারণে গুগোলের এই অনবদ্য "লিংক-গণণা" নীতিই আজকের গুগোলের সাফল্যের মূলমন্ত্র। ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপণের ক্ষেত্রে গুগোল এনেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। প্রতিবার গুগোলের সার্চ বক্সে আপনি যা লিখে সার্চ দিচ্ছেন তা আপনার মনের একটি অংশের তথা আপনার চিন্তা ভাবনার একটি ক্ষুদ্র অংশ তুলে ধরছে। গুগোল বিজ্ঞাপণের ক্ষেত্রে এই অভূতপূর্ব নীতি অবলম্বন করলো। তারা বুঝতে পেরেছিলো কোন ইন্টারনেট ব্যবহারকরীই অবাঞ্ছিত বিজ্ঞাপণ দেখতে চান না। আর তাই গুগোল শুধু সেই বিজ্ঞাপণই দেয় যা আপনার সার্চ টার্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ব্যাপারটা অনেকটা এমনভাবে চিন্তা করা যেতে পারে: আপনি যদি "Linkin Park" লিখে সার্চ দেন তার থেকে দু'টো জিনিস প্রতীয়মান হয়-
১. আপনি Linkin Park এর ব্যাপারে জানতে আগ্রহী
২. আপনি হয়তোবা Linkin Park এর নতুন এ্যালবামটি অনলাইনে ক্রয় করতেও আগ্রহী।
ঠিক এই নীতিটিই গুগোল তাদের বিজ্ঞপণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা ধরে নিতেই পারি যে, প্রতিবার আপনি যখন "Car" লিখে গুগোলে সার্চ দেন BMW বা Ferrari এর মতো কোম্পানী অবশ্যই চাইবে সেখানে তাদের একটি বিজ্ঞাপণ থাকুক এবং সেজন্য তারা টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপণও দেবে। অবাঞ্ছিত বিজ্ঞাপণ থেকে ব্যবহারকারীদেরকে মুক্তি দিতে এর চাইতে ব্রিলিয়ান্ট কোন আইডিয়া আদৌ সম্ভব ছিলো কি? হয়তো না।
তবে আপনি যদি ভেবে থাকেন যে এমন একটি সম্ভাবনাময় কোম্পানীর শুরুতেই বিনিয়োগকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো তবে আপনি ভুল ভাববেন। প্রকৃতপক্ষে এমন একটা সময় গুগোলের গিয়েছে যখন সিলিকন ভ্যালির প্রতিটি সার্চ প্রোভাইডারের দ্বারে দ্বারে তারা তাদের এই অনন্য আইডিয়ার পরীক্ষামূলক সংস্করণ নিয়ে গিয়েছে কিন্তু কেউ কোন সারা দেয়নি। এমনকি এক্সাইটের মতো কোম্পানী গুগোলের পুরো আইডিয়া মাত্র ১ মিলিয়ন ডলানে কিনে নেবার সুযোগ পেয়েও কেনেনি, কারন তারা গুগোলের কোন ভবিষ্যৎ দেখেনি। আজ গুগোলের মূল্য আন্দাজ করাও কষ্টকর তবে ১০০ বিলিয়ন ডলারের উপরে সন্দেহ নেই কোন। মার্কেটে মেয়ার উন্মুক্ত করার ৩ বছরের মাথায় গুগোলের শেয়ারমূল্য ছাড়িয়ে যায় Macdonalds, Fedex, Intel, Coke, Walmart, IBM এর মূল্যকে ছাড়িয়ে যায়। ১০০ ডলার থেকে শুরু হওয়া শেয়ারগুলোর বর্তমান মূল্য ৭০০ ডলার।
এতো সাফল্য, এতো জনপ্রিয়তা। সবসময়ই যোগ হচ্ছে ইউটিউব, গুগোল আর্থ, গুগোল ম্যাপস, পিকাসার মতো অনন্য সব সেবা।
সেবার পাশাপাশি গুগোলের প্রতিদ্বন্দী আর শত্রু দু'টোর তালিকায় রোজ বড় হচ্ছে। এ তালিকায় সবার উপরে নাম থাকবে অবশ্যই মাইক্রোসফটের। ইতিহাস সাক্ষী আছে, মাইক্রোসফট বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে অভ্যস্ত। সবার পরে এসেও বাজিমাত মাইক্রোসফট ইতিপূর্বেও করেছে। এখনো তারা সেই চেষ্টা করবে সন্দেহ নেই। গুগোলের অনানুষ্ঠানিক মূলমন্ত্র হলো: "Don't be evil"। গুগোল আজ পর্যন্ত এই নীতি সুষ্ঠুভাবে পালন করে এসেছে। এই নীতি ভবিষ্যতেও তাদের কাজে লাগবে সন্দেহ নেই কোন।
পরিশেষ:
* ব্রিন ও পেইজ বর্তমানে পৃথিবীর শীর্ষ ৩০ ধনীদের দু'জন।
* একটি ভারতীয় মোবাইল ফোন কোম্পানীর Moto হচ্ছে: "An idea can change your life"। কথাটি ইয়াহু ও গুগোলের জন্য অবশ্যই প্রযোজ্য।
* ডিসকভারি চ্যানেলে প্রচারিত Download - The True History of Internet অনুষ্ঠান অবলম্বনে রচিত।
কৃতজ্ঞতা:
এই পোস্টের কিছু ছবি ও সকল বহির্গামী লিংক উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত
অন্যান্য পর্বসমূহ:
১ম পর্ব: ব্রাউসার যুদ্ধ
৩য় পর্ব: ইন্টারনেট ব্যবসা - ডট কম বাবল
৪র্থ পর্ব: ওয়েব বিপ্লব
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment