Sunday, April 4, 2010

থ্রিজি প্রযুক্তি ও বাংলাদেশ

টেলিযোগাযোগ বা মোবাইল কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে থ্রিজি নেটওয়ার্ক হচ্ছে অত্যাধুনিক সংস্করণের একটি৷ নিচে থ্রিজি প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-

থ্রিজি প্রযুক্তি কি?
আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন সংস্থা বা আইটিইউ এর সংজ্ঞানুসারে থ্রিজি প্রযুুক্তি হচ্ছে এমন এক মোবাইল প্রযুক্তি যাতে জিএসএম, ইডিজিই, ইউএমটিএস এবং সিডিএমএ-২০০০ প্রযুক্তি অন্তর্ভূক্ত৷ এই প্রযুক্তির সাহায্যে ডিইসিটি এবং ওয়াইম্যাক্স সার্ভিস, ভয়েস কল, ভিডিও কল এবং ওয়্যারলেস ডাটা সবই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আদান-প্রদান করা যায়৷ থ্রিজি প্রযুক্তি একই সাথে ভয়েস সার্ভিস এবং উচ্চগতি সম্পন্ন ডাটা সার্ভিস (১৪ এমবিপিএস পর্যন্ত ডাউনলিংক এবং ৫.৮ এমবিপিএস পর্যন্ত আপলিংক) সাপোর্ট করে৷ থ্রিজি প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইলে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ডিভাইসের মাধ্যমে এবং স্যাটেলাইটের সাহায্যে একজন ব্যবহারকারীর অবস্থান জানা সম্ভব৷ নোকিয়া, স্যামসাং, মটোরোলা, সনি এরিকসন থ্রিজি সাপোর্টেট বিভিন্ন মডেলের হ্যান্ডসেট বাজারজাত করছে৷

থ্রিজি প্রযুক্তি সুবিধা
থ্রিজি প্রযুক্তি কার্যকর থাকলে একটি সাধারণ থ্রিজি সাপোর্টেট মোবাইল হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে অনেকগুলো কাজ সম্পাদন করা যায়৷ থ্রিজি প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় সুবিধা হল, এই প্রযুক্তি কার্যকর থাকলে মোবাইল হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে ভয়েস সুবিধার পাশাপাশি ব্যবহারকারী ভৌগোলিকভাবে যে অবস্থানেই থাকুক না কেন উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে৷ গ্রামের অর্ধশিক্ষিত একজন মানুষ সবসময় সবখানে বসে সারাবিশ্বের সাথে যোগাযোগ এবং সবধরনের তথ্য অতি সহজেই আদান-প্রদান করতে পারে৷ থ্রিজি প্রযুক্তির মাধ্যমে টিভি দেখা, খেলা দেখা, ভিডিও ক্লিপস আদান-প্রদান সবই সম্ভব৷ একজন ব্যবহারকারী থ্রিজি সাপোর্টেট মোবাইল সেটের সাহায্যে ভিডিও কনফারেন্স করতে পারে৷ বিনোদনের ক্ষেত্রে এটি অদ্বিতীয় ভিডিও টেলিফোনি পাওয়ারফুল ক্যামেরা, ইমেজ এডিটিং, ব্লগিং, ভিডিও কল, মুভি ট্রান্সফার সবই সম্ভব৷ বাণিজ্যিক কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে থ্রিজি অসাধারণ৷ একজন বাণিজ্যিক কর্মকর্তা যেকোন জায়গায় বসে এমএস ওয়ার্ড, এক্সলে, পাওয়ার পয়েন্ট, পিডিএফ ফাইল এবং অন্যান্য ফরমেটের ফাইল সে পড়ে এবং সংশোধন করে আপলোড ডাউনলোডের মাধ্যমে তার ব্যবসায়িক কর্ম সম্পাদন করতে পারে৷ কাস্টামার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট (সিআরএম) মেইনটেইন করা সম্ভব থ্রিজি টেকনোলজির সাহায্যে৷ থ্রিজি প্রযুক্তি কার্যকর থাকলে চিকিত্‍সা ক্ষেত্রে টেলি-মেডিসিন সার্ভিস আরো সহজ ও কার্যকরভাবে প্রদান করা সম্ভব৷ এক কথায় থ্রিজি প্রযুক্তির সার্ভিস যখন আমরা ব্যবহার করতে পারব তখনই কেবল আমরা এর পূণর্াঙ্গ সুবিধা উপলব্ধি করতে পারব৷

থ্রিজি এর ইতিহাস
থ্রিজি মোবাইল প্রযুক্তি জাপানে ১ অক্টোবর ২০০১ সালে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম বাজারে নিয়ে আসে এনটিটি ডোকোমো নামক মোবাইল অপারেটর কোম্পানি৷
এসকে টেলিকম নামক অপারেটর ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ কোরিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে থ্রিজি প্রযুক্তি বাজারে নিয়ে আসে৷ একই দেশে দ্বিতীয় থ্রিজি নেটওয়ার্ক সাপোর্টেট অপারেটর হিসেবে কেটি কোম্পানি আত্মপ্রকাশ করে৷ এর ফলে দক্ষিণ কোরিয়াতে থ্রিজি সাপোর্টেট অপারেটরদের ভেতরে প্রতিযোগিতা শুরু হয়৷
২০০১ সালের ডিসেম্বরে ইউরোপে টেলিনর নামক অপারেটরটি থ্রিজি মোবাইল প্রযুক্তি বাজারে নিয়ে আসে৷ ইউএসএ'তে প্রথম এমওনেট মোবাইল নেটওয়ার্ক- থ্রিজি নিয়ে কাজ করা শুরু করলেও বাণিজ্যিকভাবে ২০০৩ সালে ভেরিজো ওয়্যারলেস নাটক অপারেটির থ্রিজি প্রযুক্তি সেবা নিয়ে বাজারে আসে৷
আফ্রিকায় ২০০৪ সালে ইএমটিএল অপারেটর থ্রিজি নিয়ে বাজারে আসে৷ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০০৮ সালে মাহনাগার টেলিফোন নিগাম লিমিটেড (এমটিএনএল) থ্রিজি নেটওয়ার্ক সুবিধা নিয়ে বাজারে আসে৷
চীন ১ অক্টোবর ২০০৯ সালে দেশের ৬০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে থ্রিজি নেটওয়ার্ক নিয়ে তিনটি কোম্পানি (চায়না মোবাইল, চায়না ইউনিকম, এবং চায়না টেলিকম) আত্মপ্রকাশ করে৷

থ্রিজি মোবাইল প্রযুক্তি এবং বাংলাদেশ
বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালে প্রথম মোবাইল অপারেটর হিসেবে প্যাসিফিক বাংলাদেশ লিমিটেড (পিবিটিএল) সিডিএমএ প্রযুক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে৷ কিন্তু দীর্ঘ ১৩ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত কোন অপারেটর থিজি প্রযুক্তি সেবা প্রদান করতে পারেনি৷এশিয়া মহাদেশে (জাপান, ২০০১) বিশ্বের মধ্যে সর্বপ্রথম থ্রিজি প্রযুক্তি শুরু হলেও দীর্ঘ ৯ বছর অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও এখনও আমরা এর সুবিধা পেতে শুরু করিনি৷ মুখে মুখে আমরা যতই আধুনিক বা ডিজিটাল বলে দাবী করি না কেন, আসলে বিশ্বায়নের এই যুগে তথ্যপ্রযুক্তিতে আমরা খুব বেশি উন্নতি সাধন করতে পারিনি৷ প্রতিবেশী দেশ ভারতে যেখানে থ্রিজি প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, সেখানে আমরা এখনও শুরু করতে পারিনি৷ আমরা এখনও মোবাইল কমিউনিকেশনে ২.৫জি প্রযুক্তি ব্যবহার করছি অথচ সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি দেশে রেণ-৪ঐ প্রযুক্তি শুরু হয়েছে৷ আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রযুক্তির উন্নয়ন অপরিহার্য৷ বর্তমানে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত যেভাবে মোবাইল সুবিধা পৌঁছে দেয়া গেছে সেভাবে যদি থ্রিজি প্রযুক্তির সুবিধা পৌঁছে দেয়া যায় তবে তারা খুব সহজেই উচ্চ গতিসম্পন্ন ডাটা সার্ভিস বা ইন্টারনেট সুবিধা ব্যবহার করে সারাবিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখতে সক্ষম হবে৷ এবং তখন নিজেরাই নিজেদেরকে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারবে৷ যা এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের দেশের উন্নতির জন্য অপরিহার্য৷ বর্তমান সরকার বাংলাদেশের প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে৷ এই সরকারের কাছে আমাদের আবেদন যে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যকর করতে হলে খুব শীঘ্রই মোবাইল অপারেটরগুলোকে থ্রিজি প্রযুক্তি সুবিধা দেয়ার লাইসেন্স দিতে হবে৷

প্রযুক্তি যেমন আশীর্বাদ আছে তেমনি অভিশাপও আছে৷ আশীর্বাদ না অভিশাপ তা নির্ভর করে ব্যবহারের উপর৷ বর্তমানে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা ও হয়রানির খবরাখবর আমরা পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই৷ থ্রিজি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিডিও কল করা সম্ভব যেখানে কলার এবং রিসিভার দুইজনই তাদের অবস্থান ও কর্মকান্ড দেখতে পাবে৷ অতএব আমাদের তরুণ সমাজকে অবশ্যই এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে৷ সবচেয়ে বড় কথা 'বিবেক হল মানুষের সর্বোচ্চ আদালত'৷ সুতরাং প্রযুক্তির ব্যবহার করতে গিয়ে যেন বিবেকের পতন না হয় সেটাই আমাদের সবার কাম্য৷ 


ই-বিজ

No comments:

Post a Comment